জোট, ভোট ও নোটের রাজনীতি – ৬ষ্ঠ পর্ব
গোপালগঞ্জ ট্র্যাজেডি ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক শঙ্কা
___ড. এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী
গোপালগঞ্জ ট্র্যাজেডি বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য একটি অশনি সংকেত। শুরুতেই জুলাই আন্দোলনের বীর সৈনিকদের উপর গোপালগঞ্জে যে বর্বরোচিত আচরণ করা হয়েছে, সেটার নিন্দা জ্ঞাপন করছি। গোপালগঞ্জে সৃষ্ট অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য কোন পক্ষ দায়ী, ইতিমধ্যেই সে দোষারোপের অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা শুরু হয়ে গেছে। সন্দেহাতীতভাবেই এ কথা বলা যায়, পরাজিত, পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তির দোসর ও অনুসারীরাই দায়ী – এতে তো কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আত্মসমালোচনা করতে গেলে, বিভিন্ন পক্ষের কতক ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত, কতক ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত ভুল চলে আসে।
আমার দৃষ্টিতে জুলাইয়ের ০১ তারিখ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত এনসিপি সারা দেশে পদযাত্রার মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক ভিত্তিকে যেভাবে মজবুত করে ফেলেছিল এবং সারাদেশে নতুন ধারার রাজনীতির যে চর্চা তৈরির সুযোগ তারা সৃষ্টি করেছিল, তার অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে গোপালগঞ্জ পথযাত্রার মাধ্যমে।
আমার দৃষ্টিতে গোপালগঞ্জে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে তা আগ থেকেই তাদের বোঝা উচিত ছিল। এক্ষেত্রে গোয়েন্দা রিপোর্ট তাদের কতটুকু সাহায্য করেছে, সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। নিঃসন্দেহে গোপালগঞ্জ বাংলাদেশেরই একটি জেলা। শুধু এনসিপি নয়; যেকোনো রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ সেখানে হতে পারে; এটা কথিত গণতান্ত্রিক অধিকার বলে। কিন্তু কখনো কখনো বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞার দৃষ্টিকোণ থেকে চরম সাহসিকতা থাকা সত্ত্বেও কিছু কাজকে avoid করতে হয়। আমার মনে হয়, সে দৃষ্টিকোণ থেকে এনসিপি গোপালগঞ্জের প্রোগ্রাম avoid করলেই ভালো হতো। আপাতত বলবো, রাজনীতি হচ্ছে যুদ্ধের মতো। যুদ্ধে যেভাবে জয় এবং পরাজয় উভয়টিকে মেনে নিতে হয়, রাজনীতিতেও সফলতা এবং ব্যর্থতা দুটোকেই মেনে নিতে হয়। জুলাই যোদ্ধা ও সৈনিকদেরকে আমার পক্ষ থেকে পরামর্শ থাকবে – গোপালগঞ্জের এই বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য তারা যেন তাদের ইস্পাতকঠিন দৃঢ় চেতনাকে খর্ব না করে; বরং আরও সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার সাথে যেন এগিয়ে যায়। এটাই তাদের কাছে আমার প্রত্যাশা থাকবে।
বিগত বর্তমান সরকার দায়িত্বে আসার পর থেকে সফলতার চেয়ে তাদের ব্যর্থতার দিকগুলোই বেশি ফুটে উঠেছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো খুব একটা সফলতার পরিচয় দিতে পারেনি। জুলাই সনদ প্রকাশে কিংবা মৌলিক অনেক সংস্কার ইস্যুতে অনেকগুলো বিষয়েও তারা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি; বরং আমরা দেখতে পারছি, রাজনীতির অঙ্গনে ইতিমধ্যেই টক্সিন ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক নেতাগণ একে অপরকে ঘায়েল করার ক্ষেত্রে এমন সব সংলাপ, বিবৃতি ও ভাষণ দিচ্ছেন – যা রীতিমতো বিষ উদগীরণ করার মতোই। যদি এই অবস্থা চলমান থাকে, তো অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার এবং যে বিপর্যয় নেমে আসবে তার খেসারত সকল স্টেকহোল্ডার, সকল পক্ষ; এমনকি অরাজনৈতিক ব্যক্তিদেরকেও দিতে হবে।
মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে বলবো, কয়েকটি বিষয়ে ইতিমধ্যেই তাদের ঐকমত্যে পৌঁছা উচিত। তা হচ্ছে –
১/ ভারতীয় আধিপত্য ও প/শ্চি/মা আধিপত্যবাদমুক্ত স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
২/ পাশাপাশি যে কোন আ/গ্রা/সন থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রাখার জন্য “মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স” গড়ে তোলা।
৩/ তৃতীয়ত: বাংলাদেশকে একটি টেকসই অর্থনীতির ওপর গড়ে তোলা।
রাজনৈতিক অনৈক্য ও বিভেদের মাধ্যমে এগুলো কখনোই বাংলাদেশের সম্ভব নয়; বরং বিগত অর্ধ শতাব্দী যেভাবে বাংলাদেশে হানাহানি, সহিংসতা, সন্ত্রাস এবং পাওয়ার পলিটিক্সের ধারা চলে এসেছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ সে ধরনের একটি পুরনো কুসংস্কারপূর্ণ রাজনৈতিক ধারাতেই ফিরে যাবে বলে মনে হচ্ছে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে বিভেদ এবং মতানৈক্য তা অনভিপ্রেত। বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দল চাচ্ছে বিএনপিকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে একেবারেই নির্বাসিত করে দেওয়া। পাশাপাশি বিএনপির মধ্যেও (অনেকের মধ্যে) এক রকম দাম্ভিকতা চলে এসেছে যে, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তারাই ক্ষমতায় যাবে। আমি মনে করি, এসব দিকই হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য নেতিবাচক দিক। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ দিলে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশই তৈরি হবে না। অতএব, কখনোই বিএনপির পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংসদে যা সম্ভব হবে না। অপরদিকে সব রাজনৈতিক দল মিলে যদি বিএনপিকে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করে, তাহলে যে পলিটিক্যাল ভ্যাকুয়াম সৃষ্টি হবে, সেজন্য বাংলাদেশ এক গভীর রাজনৈতিক সংকটে ধাবিত হবে। তাতেও বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন করা এবং একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তোলা অনিশ্চিত হবে।
দুঃখজনক সত্য যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব যারা দিচ্ছেন, তাদের মধ্যেও রয়েছে যথেষ্ট ইনসাফের অভাব। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের বুদ্ধিজীবীরাই ব্র্যাকেট বন্দী হয়ে আছেন। তারা এমন কোন পরামর্শ নিজ দক্ষতা অনুযায়ী নিজ দলকে দেন না – যেটি দলীয় স্বার্থের বিপক্ষে যায়। যতদিন পর্যন্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মানুষগুলো বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা থেকে বেরিয়ে না আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের টাকা-পয়সা কামাই করে পকেট ভারি করাই সম্ভব হবে। টকশোগুলোতে টকারু হিসেবে পাণ্ডিত্য ঝাড়ার সুযোগ হবে; কিন্তু দেশ ও জাতির জন্য তারা কিছুই করতে পারবে না।
এনসিপির উচিত শক্ত ভিত্তির উপর তাদের রাজনৈতিক ভিতকে গড়ে তোলা। তার জন্য আমি বলবো, জাতীয় নাগরিক পার্টি; তাদের দলে প্রবীণ কিছু রাজনীতিবিদদেরও স্থান করে দেওয়া উচিত। তার কারণ হলো রাজনীতির দুটো দিক। যথা –
Theoretical politics
Applied politics
Theoretical politics-এ যথেষ্ট মেধা ও যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেন – এরকম অনেক লোক এনসিপিতে আছেন; যারা দর্শন, আইন বিভাগ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র আছেন। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনীতি করার জন্য Theoretical politics করার চেয়েও দরকার Applied politics। ব্যবহারিক রাজনৈতিক জ্ঞান ছাড়া কোন রাজনৈতিক দলকে বাংলাদেশে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সে কথার সাক্ষ্য দেয়।
৭৫ ট্র্যাজেডিতে বাকশালের পতনের পর আধিপত্যবাদ বিরোধী, সমৃদ্ধ, আত্মনির্ভর একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদান অনস্বীকার্য। তিনিও যখন বিএনপিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, আওয়ামী লীগের পোড় খাওয়া প্রবীণ কিছু রাজনীতিবিদকেও তিনি তার দলে জায়গা করে দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানের হত্যার পরে আমরা দেখেছি যে, জেনারেল এরশাদ যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসলেন, তিনিও জাতীয় পার্টিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি – উভয় দল থেকেই পোড় খাওয়া রাজনৈতিক নেতাদেরকে জায়গা করে দিয়েছিলেন।
তার কারণ হচ্ছে – তৃণমূল পর্যায় থেকে যারা বাংলাদেশে রাজনীতি করে বড় হয়েছেন, রাজনৈতিকভাবে পোড় খাওয়া – বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেকোনো রাজনৈতিক দলকে শক্ত ও মজবুত রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রবীণ পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদদের প্রয়োজন আছে। আমার মনে হয়, এদিকটিতে এনসিপি অনেকটাই পিছিয়ে আছে। “জুলাই বিপ্লবের” সৈনিকগণ দুঃসাহসী জাতীয় বীর – তাতে কোন সন্দেহ নাই; কিন্তু তাদের ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে, বিবেককে পরিহার করে শুধুমাত্র আবেগপ্রবণ হয়ে রাজনীতি করতে গেলে, তাদেরকে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হতে পারে।
সেজন্য আমার পক্ষ থেকে এনসিপিকে কয়েকটি পরামর্শ:
প্রথমত: প্রত্যেক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিছু স্তম্ভের উপর। অর্থাৎ সেই রাজনৈতিক দলের মৌলিক আদর্শ কী? এনসিপিকে তার মৌলিক আদর্শগুলো কী – তা নির্ধারণ করতে হবে। তার মধ্যে আমার পক্ষ থেকে পরামর্শ থাকবে – যেহেতু বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রাষ্ট্র, সেহেতু এ দেশের ইসলাম ও মুসলমানকে বাদ দিয়ে দেশের স্বাধীনতাকেও কল্পনা করা যায় না। অতএব, এনসিপির মৌলিক আদর্শের মধ্যে প্রথমেই যে বিষয়টিতে স্থান বিবেচনায় আনা উচিত – তারা যেন ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী হন।
দ্বিতীয়ত: রাজনৈতিকভাবে তাদের স্পষ্ট করতে হবে জাতির কাছে যে, ভারতীয় আধিপত্যবাদের পাশাপাশি প/শ্চি/মা আ/গ্রা/সন থেকেও বাংলাদেশকে তারা মুক্ত রাখবে।
তৃতীয়ত: যে বিষয়টিতে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে সেটি হচ্ছে – দেশবিরোধী যেকোনো চক্রান্তের বিরুদ্ধে তাদের ইস্পাতকঠিন অবস্থানে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়াতে হবে। আমরা দেখতে পেয়েছি ইতিমধ্যে দেশবিরোধী কিছু ইস্যু মাথাচাড়া দিয়েছিল, তার মধ্যে –
১. করিডর ইস্যু
২. বন্দর ইস্যু
বর্তমানে চলমান যে বিষয়টি ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ও দেশপ্রেমিক প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে, সেটা হচ্ছে – ঢাকায় “জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন” স্থাপন। এ বিষয়গুলোতে এনসিপি একেবারেই নিশ্চুপ – যা এ দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে অনাস্থার সৃষ্টি করে।
আমাদের জেনে রাখা উচিত এবং গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত – যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আস্থা না আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কখনোই সে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যেতে পারে না।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে হেদায়েত করুন, সফলতা দান করুন।